স্টারলিংক ব্যবহার করে সর্বনাশা ডিজিটাল ফাঁদ
নিজস্ব প্রতিবেদন: আপনি রাতে মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টে লাখ টাকার সঞ্চয় রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমালেন। কিন্তু সকালে উঠে দেখলেন, আপনার অজান্তেই সেই টাকা উধাও! ব্যাংক থেকে আসা মেসেজ জানাচ্ছে, আপনার অ্যাকাউন্টের সমস্ত অর্থ তুলে নেওয়া হয়েছে। এই পরিস্থিতি এখন আর কেবল কল্পনা নয়—বাস্তবে হরহামেশাই ঘটছে। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ তথ্য হলো, ইলন মাস্কের স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা স্টারলিংক ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্র পুরো অঞ্চলে জাঁকিয়ে বসেছে।
গত এপ্রিলে বাংলাদেশে পরীক্ষামূলকভাবে ইলন মাস্কের স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা 'স্টারলিংক' চালু হয়। তখন অনেকেই এই উদ্যোগের প্রশংসা করেছিলেন, কারণ বলা হচ্ছিল—দেশের দুর্গম পাহাড়ি এলাকা থেকে শুরু করে কর্পোরেট টাওয়ার পর্যন্ত সব জায়গায় সমান গতিতে ইন্টারনেট পৌঁছে যাবে। কিন্তু সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক তথ্য বলছে, আপনার ফোনে থাকা বিকাশ, নগদ বা যেকোনো ব্যাংকিং অ্যাপ সামান্য অসতর্কতায় মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
স্টারলিংক কী এবং কেন এটি ঝুঁকিপূর্ণ
স্টারলিংক হলো স্পেসএক্স পরিচালিত একটি স্যাটেলাইট-ভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা। পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে প্রায় ৬,০০০ ক্ষুদ্র স্যাটেলাইটের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে এটি ইন্টারনেট সংযোগ দেয়। এই বিশেষ নেটওয়ার্কের কারণে এটি সহজে যেকোনো জায়গায় ইন্টারনেট সরবরাহ করতে পারে, যেখানে মোবাইল টাওয়ার বা ফাইবার লাইন পৌঁছায় না। এজন্য এটি যুদ্ধক্ষেত্র, দুর্গম গ্রাম এমনকি সমুদ্রেও কার্যকর। ইউক্রেন যুদ্ধে স্টারলিংক রাশিয়ার ইলেকট্রনিক ব্লকেডের বিরুদ্ধে প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
স্যাটেলাইট-ভিত্তিক হওয়ায় এই নেটওয়ার্কটি সহজে কোনো রাষ্ট্রীয় টেলিকম নেটওয়ার্কের নিয়ন্ত্রণে আসে না। ফলে সেন্সরশিপ বা ব্ল্যাকআউট সহজেই এড়িয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু এই সুবিধাই এখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এক সর্বনাশা প্রতারণার হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।
এশিয়ার 'স্ক্যাম সিটি' এবং স্টারলিংকের ব্যবহার
মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, লাওস, ফিলিপাইন ও পূর্ব তিমুরে এখন গড়ে উঠেছে এক ভয়াবহ 'নেটওয়ার্ক স্ক্যাম সিটি'। এগুলো যেন আধুনিক দাস প্রথার ডিজিটাল সংস্করণ। জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ দপ্তর (UNODC) বলছে, ২০২৩ সালে এই প্রতারণা নেটওয়ার্কগুলো ১৮ থেকে ৩৭ বিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নিয়েছে।
এই চক্রগুলো স্টারলিংক ব্যবহার করছে প্রধানত তিনটি কারণে:
১. অবিচ্ছিন্ন সংযোগ: এটি স্থানীয় টেলিকম নেটওয়ার্কের ওপর নির্ভরশীল নয়। ফলে সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করলেও তাদের সংযোগ অটুট থাকে।
২. নজরদারির বাইরে: ডেটা ট্রাফিক সরাসরি স্যাটেলাইটের মাধ্যমে যায়, যা স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা সংস্থার নজরদারিতে সহজে ধরা পড়ে না।
৩. পোর্টেবিলিটি: স্টারলিংক সহজে পোর্টেবল। ছোট ডিশ ও পাওয়ার ইউনিট নিয়ে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নতুন জায়গায় বসানো যায়। ফলে কোনো এলাকায় অভিযান শুরু হলে প্রতারক দল দ্রুত অন্যত্র সরে গিয়ে আবার নেটওয়ার্ক চালু করতে পারে। এটি যেন আকাশে বসে থাকা এক 'ভুতুড়ে নেটওয়ার্ক' যা পৃথিবীর আইনকে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে।
থাই-মিয়ানমার সীমান্তের 'কে কে পার্ক' এখন এই অন্ধকার নেটওয়ার্কের প্রতীক। সম্প্রতি মিয়ানমার সেনাবাহিনী সেখানে অভিযান চালিয়ে ৩০ সেট স্টারলিংক রিসিভার উদ্ধার করেছে এবং ২,০০০ এরও বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করেছে বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। ওই এলাকা মূলত অনলাইন জুয়া, বিনিয়োগ প্রতারণা, মানব পাচার এবং মানি লন্ডারিংয়ের ঘাঁটি।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা গেছে, এই পার্কের ছাদে শাড়িবদ্ধভাবে বসানো স্টারলিংক ডিশ যেন কোনো গোপন সামরিক ঘাঁটি। এমন চিত্র কম্বোডিয়ার সিহানুক বিল এবং লাওসের গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল অঞ্চলেও পাওয়া গেছে। বাংলাদেশের পাশে এমন 'লঙ্কা কাণ্ড' দ্রুতই বাংলাদেশেও আতঙ্ক ছড়াচ্ছে।
প্রতারণার কৌশল ও ডিজিটাল দাসত্ব
এই চক্রগুলো নানা রকম ফাঁদ তৈরি করে: 'রোমান্স স্ক্যাম' (ভুয়া পরিচয়ে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া), 'পিগ বাচারিং' (প্রথমে ছোট লাভ দেখিয়ে বিনিয়োগে আগ্রহী করা, পরে বড় অংকে হাত সাফ করা), ক্রিপ্টো প্রতারণা এবং অনলাইন জুয়া। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মানব পাচার। তরুণদের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে বন্দি করে রাখা হয় এবং দিনের নির্দিষ্ট সংখ্যক লোককে প্রতারণা করতে না পারলে তাদের ওপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। জাতিসংঘ এটিকে 'ডিজিটাল দাসত্ব' বলে অভিহিত করছে।
বাংলাদেশের ঝুঁকি ও প্রতিরোধের উপায়
ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে প্রচলিত ইন্টারনেট ব্যবহার করেই অনলাইন জুয়া ও বহু-মাত্রিক প্রতারণা (মোবাইল ব্যাংকিং স্ক্যাম, ফিশিং, ভুয়া কাস্টমার কেয়ার) ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে স্টারলিংকের মতো আধুনিক ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে স্ক্যামাররা কী করতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। আমরা একই স্যাটেলাইট কাভারেজ জোনে পড়ায় ঝুঁকি দ্রুত ঘনিয়ে আসছে।
ইন্টারনেট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্টারলিংক বন্ধ করা নয়, বরং এর উৎস শনাক্ত করার সক্ষমতা বাড়ানো এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা দরকার। সরকারকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রযুক্তি সক্ষমতা বাড়াতে হবে এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার করতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করেন, দেশে যদি স্টারলিংকের স্থানীয় 'গ্রাউন্ড স্টেশন' স্থাপন করা যায়, তবে প্রতারণা শনাক্ত করা সহজ হবে। কারণ স্থানীয়ভাবে টার্মিনালের ব্যবহার, ডেটা ট্র্যাফিক ও অবস্থান ট্র্যাক করা সম্ভব হবে। সাইবার নিরাপত্তা সংগঠন 'সাইবার ৭১'-এর পরিচালক আবদুল্লাহ আল জাবের মনে করেন, বাংলাদেশের বর্তমান সক্ষমতা সীমিত, তাই ভবিষ্যতের জন্য গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপন ও স্টারলিংকের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়ানো জরুরি।
সাইবার অপরাধ মোকাবেলায় দেশে পুলিশের সাইবার ক্রাইম সেন্টার কাজ করছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রযুক্তির গতি আইনি প্রক্রিয়ার চেয়ে বহু গুণ দ্রুত। সিআইডি স্বীকার করেছে, সাইবার স্পেসের সীমানা নেই, ঝুঁকি তাই ব্যাপক।
পুলিশের নজরদারি থাকলেও নাগরিকদের সচেতনতা বৃদ্ধি না পেলে তা যথেষ্ট নয়। তাই এখন সাবধানতা অবলম্বন করা অত্যাবশ্যক। সন্দেহজনক লিংক ক্লিক না করা, অজানা কাস্টমার কেয়ার বা রোমান্স অ্যাকাউন্টে সাড়া না দেওয়া, এবং অনলাইন লেনদেনে 'টু-ফ্যাক্টর অথেন্টিকেশন' ব্যবহার—এই ছোট অভ্যাসগুলোই আপনাকে বড় বিপদ থেকে সুরক্ষা দিতে পারে। তাই এখনই সাবধান হন, নইলে বড় বিপদে পড়তে পারেন আপনিও।
আশা/
আপনার জন্য নির্বাচিত নিউজ
- নতুন পে স্কেল কার্যকর যে মাসে
- দ্বিগুণ উৎসব ভাতা, ৮০% বাড়ি ভাড়া ও ভাতা বাড়ানোর প্রস্তাব
- নতুন পে-স্কেল কার্যকর হচ্ছে ২০২৬ সালের জানুয়ারি মাস থেকে
- রেকর্ড দরপতনের পর সস্তা হলো সোনা দাম, আজ এক ভরি কত
- কমিশনে ১১-২০ গ্রেড; ৩২ হাজার টাকা সর্বনিম্ন বেতনের প্রস্তাব
- আবারও টানা ৩ দিনের ছুটি পাচ্ছেন সরকারি চাকরিজীবিরা
- বাংলাদেশে বড় পতনের পর আজ সোনার ভরি কত
- সর্বোচ্চ বেতন ২ লাখ ২০ হাজার, সর্বনিম্ন ৪০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব
- সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য সুখবর: আরও একটি লম্বা ছুটি আসছে
- নতুন বেতন কাঠামো: বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্যও সুখবর
- নতুন পে-স্কেল: আরও ১০ সংগঠনের সঙ্গে বসছে জাতীয় বেতন কমিশন
- রেকর্ড পতনের পর বাড়ল স্বর্ণের দাম
- শনিবার বিদ্যুৎ থাকবে না দেশের যেসব এলাকায়
- হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে শেষ হল বাংলাদেশ-থাইল্যান্ডের ম্যাচ, দেখুন ফলাফল
- নতুন পে-স্কেল: চিকিৎসা ভাতা ৫০০০, শিক্ষা ভাতা ৩০০০ করার প্রস্তাব
