নিজস্ব প্রতিবেদন: ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় অবশেষে স্বীকার করেছেন যে, তার মায়ের সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে কিছু 'ভুল' হয়েছিল।

তবে একই সঙ্গে তিনি জাতিসংঘের সেই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন, যেখানে অভিযোগ করা হয়— অভ্যুত্থান দমনের সময় সরকার ১,৪০০ মানুষকে হত্যা করেছে।

ওয়াশিংটন ডিসি থেকে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জয় কঠোর হুঁশিয়ারি দেন। তিনি বলেন, নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার যদি আওয়ামী লীগের ওপর থেকে রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার না করে এবং সব দলের অংশগ্রহণে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন আয়োজন না করে, তবে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলতে থাকবে।

তিনি অভিযোগ করেন, "এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে হবে, নির্বাচন হতে হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক, অবাধ ও সুষ্ঠু।" তার মতে, "এখন যা হচ্ছে, তা আসলে আমার মা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে দূরে রাখার একটি রাজনৈতিক কৌশল।"

২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনের অবসান এবং ভারতে তার পালানোর পর এটিই হবে প্রথম নির্বাচন। ক্ষমতাচ্যুতির তিন দিন পর ড. ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন এবং দেশে শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেন।

কিন্তু গত মে মাসে ইউনূস সরকার আওয়ামী লীগের সব ধরনের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং দলটির শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার করে। অনেক নেতা দেশ ছেড়ে ভারত ও অন্যান্য দেশে পালিয়ে যান। বর্তমানে হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ থেকে শুরু করে দুর্নীতির বিভিন্ন অভিযোগে একাধিক মামলা চলমান।

মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস সহ ছয়টি আন্তর্জাতিক সংস্থা সম্প্রতি ড. ইউনূসের কাছে একটি যৌথ চিঠি পাঠিয়ে আওয়ামী লীগের ওপর আরোপিত 'অতিরিক্ত নিষেধাজ্ঞা' প্রত্যাহারের আহ্বান জানায়। সংস্থাগুলো দাবি করে, এই নিষেধাজ্ঞা মতপ্রকাশ ও সংগঠনের স্বাধীনতার পরিপন্থি এবং শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

জয় জোর দিয়ে বলেন, আওয়ামী লীগকে প্রস্তুতির জন্য পর্যাপ্ত সময় না দিলে এই নির্বাচন জনগণ ও আন্তর্জাতিক মহলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। তার কথায়, "এখনই আমাদের নির্বাচনী প্রস্তুতি নিতে দেওয়া হচ্ছে না—শেষ মুহূর্তে নিষেধাজ্ঞা উঠলেও নির্বাচন হবে এক প্রহসন।"

বর্তমানে বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের সংসদীয় গণতন্ত্রে ৫২টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল রয়েছে। হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশে এখনো গণতান্ত্রিক রূপান্তর প্রক্রিয়া চলছে।

এদিকে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি আসন্ন নির্বাচনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উঠে এসেছে। সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হলো—এক দশকেরও বেশি সময় পর নিষিদ্ধ জামায়াতে ইসলামী রাজনীতিতে ফিরে এসেছে। গত এক বছরে তারা সংগঠন পুনর্গঠন করেছে এবং অন্যান্য ইসলামপন্থি দল ও গোষ্ঠীর সঙ্গে জোট গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছে।

জয় সতর্ক করে বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা যদি অব্যাহত থাকে, তবে ইসলামপন্থি দলগুলোই লাভবান হবে। তিনি সরাসরি অভিযোগ করেন যে, ড. ইউনূস তাদের মদদ দিচ্ছেন এবং ‘প্রহসনের নির্বাচন’ আয়োজনের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতায় আনার চেষ্টা করছেন।

মানবাধিকার ইস্যুতে জয় বলেন, "সব হত্যাকাণ্ডই দুঃখজনক এবং এর তদন্ত হওয়া উচিত।" তবে তিনি পাল্টা অভিযোগ করেন, ইউনূস সরকার অভ্যুত্থানকালে সহিংসতাকারীদের দায়মুক্তি দিয়েছে এবং শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ‘ডাইনী শিকার অভিযান’ শুরু করেছে। তিনি সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনালে একজন প্রসিকিউটর কর্তৃক হাসিনার মৃত্যুদণ্ড দাবির বিষয়টি উল্লেখ করেন। হাসিনা এই বিচারকে ‘ক্যাঙ্গারু কোর্ট’ আখ্যা দিয়ে কোনো আইনজীবী নিয়োগ করেননি।

জয় আরও দাবি করেন, ইউনূস সরকারের মানবাধিকার রেকর্ডও ভয়াবহ। তার ভাষায়, "আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতা-কর্মী এক বছরেরও বেশি সময় ধরে জেলে, জামিন পাচ্ছেন না; প্রায় ৫০০ নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে, ৩১ জন মারা গেছেন হেফাজতে।" তিনি অভিযোগ করেন, সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দুরাও এখন লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

সোহাগ/