ঢাকার আকাশে নীরবতা থাকলেও, আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির রাডারে এখন তীব্র আলোড়ন। চট্টগ্রাম বন্দরে একটি মার্কিন নৌ-জাহাজের উপস্থিতি ঘিরে দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক ও প্রতিরক্ষা মহলে তোলপাড় চলছে। সরকার এটিকে 'দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ' বললেও, অভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষা সূত্র এবং আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এর উদ্দেশ্য মানবিক নয়, বরং এটি এই অঞ্চলে কৌশলগত অবস্থান নিশ্চিত করার এক গভীর প্রস্তুতি।

রাখাইন ইস্যু: মানবিক সমাধান নাকি কৌশলগত সংযুক্তি

২০১৯ সালে মার্কিন কংগ্রেসের সদস্য ব্র্যাড শেরম্যান রাখাইন প্রসঙ্গে একটি বিস্ফোরক মন্তব্য করেছিলেন: যে দেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে, সেই বাংলাদেশের সঙ্গে রাখাইন যুক্ত করাই যৌক্তিক। দীর্ঘ সময় এই বক্তব্য উপেক্ষিত হলেও, ২০২৫ সালে এসে বঙ্গোপসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান সক্রিয়তা সেই ধারণাটিকে নতুন প্রেক্ষাপটে ফিরিয়ে এনেছে।

* নীরব ভূমিকম্প: ২০১৯ সালের ২৮ জুনের সেই মার্কিন শুনানিতে রাখাইনকে সংযুক্ত করার ধারণা উত্থাপন করা হয়েছিল। এটি একদিকে মানবিক সংকটের সমাধান, অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্য বদলে দেওয়ার সূচনা হিসেবে দেখা হচ্ছে।

* সংঘাতের কেন্দ্র: রাখাইনে আরাকান আর্মির উত্থান এবং জান্তা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ ভাঙার ঘটনা পরিস্থিতি আরও জটিল করেছে। রাখাইনের যুদ্ধ এখন চীন ও ভারতের উদ্বেগকে বাড়িয়ে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এটিকেই একটি 'হিউম্যানিটারিয়ান জোন' ঘোষণার সুযোগ হিসেবে দেখছে, যার নেতৃত্বে থাকতে পারে বাংলাদেশ।

ভারতের অস্বস্তি: 'সফট মিলিটারি এক্সপ্যানশন'

চট্টগ্রাম উপকূলে অনুষ্ঠিত এই মানবিক সহায়তা অনুশীলনকে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছে। ভারতের প্রধান ধারার পত্রিকাগুলো (যেমন, দ্য হিন্দু ও টাইমস অব ইন্ডিয়া) লিখেছে:

* সামরিক নেটওয়ার্ক: চট্টগ্রাম বন্দরে মার্কিন উপস্থিতি কেবল মানবিক নয়, এটি বঙ্গোপসাগরে আমেরিকার সামরিক নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের অংশ।

* জিও স্ট্রাটেজিক খেলা: ভারতীয় বিশ্লেষকরা এটিকে 'সফট মিলিটারি এক্সপ্যানশন' হিসেবে দেখছেন, যা অজান্তে বাংলাদেশকে নতুন এক ভূ-রাজনৈতিক খেলায় টেনে আনছে।

* দিল্লির উদ্বেগ: ভারতীয় প্রতিরক্ষা মহলের আশঙ্কা—চট্টগ্রাম বন্দরে মার্কিন উপস্থিতি স্থায়ী হলে তা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল (ত্রিপুরা ও মিজোরাম সীমান্ত) এবং কৌশলগত ভারসাম্য নষ্ট করবে। দিল্লি উদ্বিগ্ন যে চট্টগ্রাম হয়ে একটি মার্কিন 'সাপ্লাই চেইন করিডর' গড়ে উঠতে পারে।

কিছু বিশ্লেষক মনে করছেন, এই মহড়ার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র তার ইন্দোপ্যাসিফিক কমান্ড (INDOPACOM) নেটওয়ার্কের এক্সটেনশন তৈরি করছে, যেখানে বাংলাদেশ একটি 'ফরোয়ার্ড অপারেটিং নোড'-এ পরিণত হতে পারে।

ঢাকা এক কূটনৈতিক দোটানায়

রাখাইন ও বঙ্গোপসাগরকে কেন্দ্র করে ঢাকা এখন এক কঠিন কূটনৈতিক দোটানায়। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে আঞ্চলিক মানবিক নেতৃত্বে দেখতে চায়, কিন্তু সেই অবস্থান ভারত ও চীনের সরাসরি অস্বস্তি তৈরি করবে।

* দিল্লির শঙ্কা: দিল্লি আশঙ্কা করছে যে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে মার্কিন প্রভাব স্থায়ী হলে তাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চল কৌশলগতভাবে ঘেরাও হয়ে যাবে।

* ভারতের দ্বিধা: চীনের মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিত্রতা জরুরি হলেও, যুক্তরাষ্ট্রের এই অতিরিক্ত সক্রিয়তা ভারতের নিজস্ব ভূ-রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করছে।

বাংলাদেশ সরকার প্রকাশ্যে এটিকে দুর্যোগ মোকাবিলার উদ্যোগ বললেও, কৌশলগতভাবে এর প্রভাব অত্যন্ত গভীর। ঢাকা এখন নীরব কূটনীতি, ভারসাম্যের কৌশল এবং সময়ক্ষেপণ-কে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।

ভবিষ্যতের মানচিত্রের নকশা

ভূরাজনীতিতে রাতারাতি কিছু ঘটে না। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আজ যা দৃশ্যমান, তার শেকড় হয়তো বহু বছর আগেই রোপণ করা হয়েছিল। আরাকান আর্মির অগ্রগতি, বঙ্গোপসাগরের নৌ-পর্যবেক্ষণ এবং চট্টগ্রামে মার্কিন কার্যক্রম—সবই যেন এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা।

আরও পড়ুন- প্রধান উপদেষ্টাকে হত্যার হুমকি, যা জানা গেল

এই ত্রিমুখী সংঘাতের কেন্দ্রে থাকা রাখাইন, চট্টগ্রাম ও বঙ্গোপসাগর—এই ত্রিভুজই হয়ে উঠছে ভবিষ্যতের দক্ষিণ এশীয় রাজনীতির নতুন কেন্দ্রবিন্দু। প্রশ্ন হলো, এই গভীর পরিকল্পনার শেষ প্রান্তে বাংলাদেশের মানচিত্র কি বদলে যাবে, নাকি এটি নতুন এক নির্ভরতার জাল তৈরি করবে?

সোহাগ/