নিজস্ব প্রতিবেদক: বিশ্ববাজারে সোনার দাম রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছালেও প্রতিবেশী দেশ ভারত, পাকিস্তান ও নেপালের চেয়ে বাংলাদেশের স্থানীয় বাজারে সোনার দাম অস্বাভাবিকভাবে বেশি। গত দুই বছরে সোনার দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, যা সাধারণ মানুষের মনে এই প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে—কেন বাংলাদেশে এই অতিরিক্ত মূল্য দিতে হচ্ছে?

বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধির মূল কারণ:

ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, গত সপ্তাহে প্রথমবারের মতো প্রতি ট্রয় আউন্স সোনার দাম প্রায় ,২০০ ডলারের (৩১.১০ গ্রাম) কাছাকাছি পৌঁছেছে। এই দ্রুত দাম বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে বৈশ্বিক অস্থিরতা:

* নিরাপদ আশ্রয়: করোনা-পরবর্তী অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বিশ্বব্যাপী মন্দার কারণে বড় বিনিয়োগকারী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো নিরাপদ সম্পদ হিসেবে বিপুল পরিমাণে সোনা কিনছে।

* স্বল্প সরবরাহ: ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী সোনার সরবরাহ প্রায় স্থিতিশীল থাকলেও, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর ক্রয় ২০২০-২০২১ সালের গড়ের তুলনায় বহুগুণ বেড়েছে।

আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় দামের ফারাক:

বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাজুস) তথ্য মতে, ২০২৫ সালের অক্টোবরে ২২ ক্যারেট সোনার দাম প্রতি ভরি (১১.৬৬ গ্রাম) প্রায় ২ লাখ ১৬ হাজার ৩৩৩ টাকায় পৌঁছেছে। একই সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি গ্রাম সোনার দাম ছিল প্রায় .৯৬ ডলার বা ১৬,৪২৫ টাকা।

তুলনামূলকভাবে, ওই সময়ে ২২ ক্যারেটের দাম ছিল:

* ভারতে: .৭০ ডলার/গ্রাম

* পাকিস্তানে: .৯৪ ডলার/গ্রাম

* নেপালে: .০৫ ডলার/গ্রাম

অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক দামের সঙ্গে বাংলাদেশি খুচরা দরের ফারাকটি 'প্রিমিয়াম' (অতিরিক্ত মূল্য) আকারে স্পষ্ট।

বাংলাদেশে অতিরিক্ত দামের প্রধান কারণ:

বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্ববাজারের দামের পাশাপাশি স্থানীয় কিছু সীমাবদ্ধতাই বাংলাদেশে সোনার দামকে অস্বাভাবিক উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে:

১. আমদানি ঘাটতি ও নীতিগত সীমাবদ্ধতা: বৈধ পথে সোনা আমদানির সুযোগ সীমিত থাকায় বাজারে মূলত রিসাইকেল্ড (পুনঃপ্রক্রিয়াজাত) সোনা এবং অনানুষ্ঠানিক (অবৈধ) উৎস থেকে আসা সোনার ওপর নির্ভর করতে হয়। এতে সরবরাহ-চাহিদার সমতা নষ্ট হয়ে যায়।

২. টাকার অবমূল্যায়ন ও শুল্কের চাপ: ডলারের তুলনায় টাকার মান কমে যাওয়ায় আমদানি খরচ সরাসরি বেড়ে যায়। উচ্চ শুল্ক-ব্যবস্থা এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতাও আমদানির খরচ বাড়িয়ে দেয়, যার বোঝা শেষ পর্যন্ত ভোক্তার ওপর পড়ে।

৩. ব্যবসায়িক মার্জিন: ব্যবসায়ীরা কখনও কখনও মুনাফার জন্য দাম বাড়ানোর প্রবণতা দেখান। যদিও তারা শুল্ক-জটিলতাকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে বলে দাবি করেন।

বাজুসের সহ-সভাপতি মাসুদুর রহমান বলেন, সরকার স্বর্ণ আমদানির সুযোগ বাড়ালে বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দিষ্ট পরিমাণ সোনা সরবরাহ করলে বাজার আরও নিয়ন্ত্রিত হতে পারত।

ভবিষ্যৎ পূর্বাভাস ও করণীয়:

সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বৈশ্বিক অস্থিরতার কারণে অনেকেই টাকার বদলে সোনা (ট্যানজিবল অ্যাসেট) কিনতে ঝুঁকছেন, ফলে বাজারে চাপ বাড়ছে।

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভের সিদ্ধান্ত, ডলারের সুদের হার এবং ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব যদি অস্থির থাকে, তবে সোনার দাম কমার সম্ভাবনা কম। গোল্ডম্যান স্যাচসের মতো বড় বিনিয়োগ ব্যাংকগুলো ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে আউন্সপ্রতি স্বর্ণের দাম ,৯০০ ডলারের কাছাকাছি পৌঁছানোর পূর্বাভাস দিয়েছে।

স্থানীয় অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বাংলাদেশের বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে সরকারের স্বচ্ছ আমদানি নীতি, শুল্ক-সংক্রান্ত সহজতা এবং টাকার স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা জরুরি। নীতিগত সংস্কার ছাড়া এই অতিরিক্ত প্রিমিয়াম থেকে স্থানীয় গ্রাহকদের মুক্তি দেওয়া কঠিন।

রাকিব/